শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৯ অপরাহ্ন
অনলাইন ডেক্স:নগরের চকবাজার এলাকার বাসিন্দা এক নারী সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে পড়েন বিপত্তিতে। একদিকে প্রসব বেদনা, অন্যদিকে ‘করোনা নেগেটিভ সনদ’ পেতে প্রাণ যাওয়ার যোগাড়। পরিচিত বিভিন্ন মাধ্যমে অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর বেসরকারি সার্জিস্কোপ হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনে মুক্তি মেলে ওই নারীর।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত না হয়েও অনেক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে এখন পোহাতে হচ্ছে নরক যন্ত্রণা। আর যাদের এ অবস্থায় করোনা শনাক্ত হচ্ছে, তাদের নিয়ে চলছে মানুষ-যমদূতের টানাটানি। নমুনা দেওয়ার এক সপ্তাহ পরও করোনা পরীক্ষার ফলাফল না পাওয়ায় তারা পড়ছেন দুশ্চিন্তায়। এই সময়ের মধ্যে তাদের যথাযথ চিকিৎসা সুবিধাও মিলছে না।
জানা গেছে, গত ১ জুন দেশের যেসব হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করা হয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেসব হাসপাতালে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের করোনা পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ। কিন্তু সেই নির্দেশ চট্টগ্রামে এখনও উপেক্ষিত। কারও নমুনা নেওয়া হলেও ফলাফল আসার আগেই ঘটছে মৃত্যু।
চট্টগ্রামে গত ২৪ মে সকালে প্রসব বেদনা উঠলে এক নারীকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এর ১৫ দিন আগে ওই নারীর করোনার উপসর্গ দৃশ্যমান হয়। পরে তার করোনা পজেটিভ হলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে।
ওইদিন দুপুরে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে পুত্র সন্তান জন্ম দেন করোনা পজেটিভ মা। হাসপাতালের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক ডা. জাহানারা শিখার নেতৃত্বে একটি টিম তার সিজারিয়ান অপারেশন করেন। চমেক ল্যাবে নমুনা পরীক্ষায় নবজাতকেরও করোনা পজেটিভ আসে।
ডা. জাহানারা শিখা বলেন, ওই প্রসূতি ছিলেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সিজারিয়ান হওয়া করোনা আক্রান্ত প্রথম রোগী। অপারেশনের দ্বিতীয় দিন রোগীর অবস্থার কিছুটা অবনতি ঘটে, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, স্যাচুরেশন ৮৬ তে নেমে যায়।
তিনি বলেন, আইসিইউতে কল দিলে সিট খালি নেই বলে জানানো হয়। এছাড়া অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকটের কারণে গাইনী ওয়ার্ডে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। এ অবস্থায় রাতভর আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে একের পর এক সিলিন্ডার টেনে আনা হয় ওয়ার্ডবয়দের সহায়তায়।‘
`রোগীর অভিভাবকরা হাইমাস্ক (হাই-ফ্লো অক্সিজেন দেওয়ার মাস্ক), এমনকি অক্সিজেন সিলিন্ডার পর্যন্ত নিজেদের উদ্যোগে কিনে আনেন আমাদের পরামর্শ মতো। মেডিসিন বিশেষজ্ঞসহ গাইনি বিভাগের অগ্রজ সহকর্মীদের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে থাকে অন্যান্য চিকিৎসা, যুক্ত হয় নতুন ওষুধ। টানা ৪৮ ঘন্টা নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন চলার পর চতুর্থ দিনে রোগীর অবস্থা উন্নতি হতে থাকে।’
এর মধ্যে মঙ্গলবার (৯ জুন) দিবাগত রাত সাড়ে ৪টার দিকে চমেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আইসিইউ সুবিধা না পেয়ে মারা যান ফাতেমা আকতার মুক্তা (৩০) নামে ১০ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সেদিন সকালে শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে তাকে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও আইসিইউতে শয্যা খালি না থাকায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর চমেক হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেও মিলেনি আইসিইউ। পরে ফাতেমার মৃত্যু হয়, এতিম হয় দুই শিশু সন্তান।
ফাতেমার ভাই মো. সোলাইমান অভিযোগ করেন, ম্যাক্স হাসপাতাল, পার্কভিউ হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েও আইসিইউতে শয্যা মিলেনি। ১৮ জুন বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারিত ছিল তার। শেষ পর্যন্ত মা ও অনাগত সন্তানকে বাঁচানো যায়নি।
চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, আইসিইউ সুবিধা না পাওয়ায় হয়তো ওই নারী মারা গেছেন। আইসিইউতে সবসময় রাখা হয় মুমূর্ষু রোগীকে। ফলে কাউকে বের করে অন্য রোগী রাখা সম্ভব হয় না। সুস্থ অথবা মারা না গেলে আইসিইউতে শয্যা পাওয়া কঠিন।
চমেক হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর ১৬০ শয্যার ওয়ার্ডে এখন রোগীর সংখ্যাও কমেছে। আগে যেখানে শয্যা ছাড়িয়ে ফ্লোরে থাকতো রোগী, এখন সেখানে রোগী তুলনামূলক কম। অন্য সময়ে দিনে গড়ে প্রায় ৮০ জন প্রসূতি বাচ্চা প্রসব করেন। এর মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫টি বাচ্চা প্রসব হয় সিজারে। বাকীগুলো হয় নরমাল ডেলিভারিতে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালেও ৫০ বেডের গাইনি ওয়ার্ডে রোগী আছেন অর্ধেক। চারটি ইউনিটে গাইনি ও প্রসূতি বিভাগে সেবা দেন এখানকার চিকিৎসকরা। এ বিভাগে সেবা চালু থাকে ২৪ ঘণ্টা। তবে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় হাসপাতালটি ব্যবহৃত হওয়ায় প্রসূতিরা সহজে যেতে চাইছেন না সেখানে।
এছাড়া চট্টগ্রামের ১৮টি বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে ডেল্টা, সার্জিস্কোপ, পার্কভিউ, মেট্রোপলিটন, রয়েল, সিএসটিসি, ন্যাশনাল, সিএসসিআর, মেডিক্যাল সেন্টার, ম্যাক্স হাসপাতাল থেকে ইতোমধ্যে অনেক রোগী ফেরত দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নগরীর ১৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং তিনটি মাতৃসদন হাসপাতালেও প্রসূতিদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা মিলছে না।
হাতেগোনা কয়েকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক, জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতাল, এনজিও পরিচালিত ক্লিনিকগুলোতে করোনার উপসর্গ না থাকার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়ে অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ভর্তি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এর সঙ্গে প্রয়োজন হচ্ছে সংশ্লিষ্ট গাইনোকোলজিস্টের সুপারিশও।
চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালে কভিড-১৯ ও নন-কভিড রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত এবং তদারকি করতে গঠিত সাত সদস্যের সার্ভিল্যান্স কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের কাছে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগী ফেরত পাঠানোর কথা স্বীকার করেছে। তবে এদের মধ্যে কোনও অন্তঃসত্ত্বা নারী ছিল কি না- তা জানা যায়নি।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সিজারিয়ানের মাধ্যমে ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে ১০ হাজারের বেশি নবজাতকের জন্ম হয়। এছাড়া প্রায় ২৫ হাজার নবজাতক নরমাল ডেলিভারিতে জন্ম নিয়েছে। ২০২০ সালের করোনা পরিস্থিতিতেও এই সংখ্যা কমবে না, বরং বাড়তে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অন্য সময়ে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নরমাল ডেলিভারির জন্য গড়ে খরচ হতো ১৫-২০ হাজার টাকা। আবার সিজার হলে ৩০-৪০ হাজার টাকা দিতে হতো। করোনার কারণে এখন সেই খরচও বেড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংবাদিক বলেন, তার স্ত্রীর ডেলিভারির সময় ঘনিয়ে আসার একমাস আগে থেকে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে হয়েছে। এরপরও প্রসব বেদনা ওঠার পর বেসরকারি একটি হাসপাতালে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্ত্রীকে ভর্তি করা হয়। অনুরোধে সাড়া দিয়ে চিকিৎসক সিজারিয়ান অপারেশন করেন। শুধু তাকেই অপারেশনের জন্য দিতে হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। এছাড়া তিনদিন হাসপাতালে থাকার বিল বাবদ এসেছে আরও ৩০ হাজার টাকা।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মোস্তফা খালেদ আহমদ বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের করোনা পরীক্ষা করানোর যে নির্দেশ হাইকোর্ট বেঞ্চ দিয়েছেন, তা এখনও আমরা লিখিত আকারে পাইনি। করোনার নমুনা সংশ্লিষ্ট ল্যাবে পাঠানোর পর সিরিয়াল অনুযায়ী ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে সিরিয়াল ভাঙা কঠিন।
তবে কোনও অন্তঃসত্ত্বা নারী যদি করোনার উপসর্গ নিয়ে নমুনা পরীক্ষার জন্য আসেন, তাদের অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। মা ও সন্তানের জীবন বাঁচানোর স্বার্থেই এটা করতে হবে।